সনাতন ধর্মে মৃতদেহ দাহ প্রথা | হিন্দুরা কেন দাহ করে | Vedayaan

জানুন কেন সনাতন ধর্মে মৃতদেহ দাহ করা হয়। পাঁচভূত তত্ত্ব, আত্মার মুক্তি, বেদীয় মন্ত্র ও অগ্নিদেবের ভূমিকা সহ সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা
সনাতন ধর্মে মৃতদেহ দাহ প্রথা | হিন্দুরা কেন দাহ করে | Vedayaan

সনাতন ধর্মে মৃতদেহ দাহ প্রথা: কারণ, দর্শন ও বেদীয় ভিত্তি

ভূমিকা

সনাতন ধর্মে মৃত্যুর পর মৃতদেহ দাহ করার রীতি হাজার বছরের প্রাচীন। এই প্রথার পেছনে রয়েছে গভীর দার্শনিক, আধ্যাত্মিক ও প্রাকৃতিক কারণ—যেখানে আগুন শুধু দেহ ভস্ম করে না, বরং আত্মাকে মুক্তি দেয় ও প্রকৃতির সঙ্গে পুনর্মিলিত করে।

১. পাঁচভূতের তত্ত্ব (পঞ্চভূত দর্শন)

সনাতন দর্শন অনুযায়ী মানবদেহ গঠিত হয়েছে পাঁচটি মৌলিক উপাদান থেকে — মাটি, জল, আগুন, বায়ু ও আকাশ। মৃত্যুর পর আত্মা দেহ ত্যাগ করে, আর দাহের মাধ্যমে দেহ পুনরায় সেই উপাদানগুলোর সঙ্গে মিশে যায়।

উপাদান দাহে কীভাবে মিশে যায়
আগুন বায়ু ও আকাশে মিলিত হয়
ভস্ম মাটিতে মিশে যায়
ছাই নদী বা জলে মিশে যায়

👉 অর্থাৎ দাহ হল দেহের প্রকৃতিতে ফিরে যাওয়ার প্রাকৃতিক নিয়ম।

২. আত্মার মুক্তি (মোক্ষ ধারণা)

হিন্দু দর্শনে মৃত্যু মানে দেহের অবসান, আত্মার নয়। আত্মা অমর এবং চিরন্তন — দেহ কেবল তার একটি বাহন। আগুন হল পবিত্রতম উপাদান, যা অপবিত্রতা দূর করে আত্মাকে মুক্ত করে দেয়। দাহ প্রক্রিয়ায় আত্মা শরীর থেকে মুক্ত হয়ে পরলোক বা পুনর্জন্মের পথে যায়।

“যেমন মানুষ পুরনো পোশাক ত্যাগ করে নতুন পরে, তেমন আত্মাও পুরনো দেহ ত্যাগ করে নতুন দেহ গ্রহণ করে।” — ভগবদ্‌গীতা ২.২২

৩. অগ্নিদেবতার ভূমিকা

অগ্নিদেবকে বেদে বলা হয়েছে দেবতা ও পুরোহিত উভয়রূপে। তিনি মানুষের আহুতি ও প্রার্থনা দেবতাদের কাছে পৌঁছে দেন। মৃত্যুর পর অগ্নিকে শরীর সমর্পণ করা মানে — “অগ্নির মাধ্যমে আত্মাকে দেবলোকে প্রেরণ করা।”

৪. স্বাস্থ্য ও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ

  • মৃতদেহ পচে রোগ ছড়ানোর ভয় থাকত না।
  • প্রাচীন ভারতে সমাধির জমি সবসময় পাওয়া যেত না।
  • আগুনে দেহ দ্রুত বিলীন হয়, প্রকৃতি দূষিত হয় না।
  • কঙ্কাল চুরি বা পশু দ্বারা হিংসার আশঙ্কা দূর হয়।
  • মহামারির সময় দাহ জীবাণু ছড়ানো রোধে সহায়ক ছিল।

৫. প্রতীকী ও সংস্কৃতিগত অর্থ

আগুন সনাতন সংস্কৃতিতে সত্য, পবিত্রতা ও আলোর প্রতীক। দাহ মানুষকে স্মরণ করিয়ে দেয় — দেহ নশ্বর, আত্মা অমর। দাহ তাই একদিকে শারীরিক বিলোপ, অন্যদিকে আধ্যাত্মিক জাগরণ।

৬. ব্যতিক্রম

সব হিন্দু সম্প্রদায় দাহ করে না। কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে দাহের পরিবর্তে সমাধি বা বিসর্জন রীতি পালন করা হয়, যেমনঃ

  • শিশু
  • সন্ন্যাসী ও জ্ঞানী সাধক
  • গঙ্গা বা পবিত্র নদীতে দেহ বিসর্জন

সনাতন ধর্মগ্রন্থে দাহ প্রথার বর্ণনা

ঋগ্বেদ — অন্ত্যেষ্টি সূক্ত (মণ্ডল ১০, সূক্ত ১৬)

ঋগ্বেদে মৃতদেহ দাহের স্পষ্ট বর্ণনা আছে। অগ্নিদেবকে আহ্বান করা হয় যেন তিনি দেহ ভস্ম করে আত্মাকে যমলোকে পৌঁছে দেন।

संस्कृत:
अग्ने क्रव्यादमसि प्रेहि मर्त्यान् नयस्वैनं यमस्येतं परस्मै ॥

বাংলা উচ্চারণ:
অগ্নে ক্রব্যাদমসি প্রেহি মর্ত্যান্, নযস্বৈনং যমস্যেতং পরস্মৈ ॥

অর্থ:
“অগ্নি! তুমি মৃতদেহ গ্রাস করো, কিন্তু আত্মাকে যমের কাছে নিরাপদে পৌঁছে দাও।”

অথর্ববেদ

অথর্ববেদে বলা হয়েছে, আগুন দেহকে পঞ্চভূতে বিলীন করে, আর আত্মা পুনর্জন্ম বা মোক্ষের পথে যাত্রা করে।

যজুর্বেদ ও সামবেদ

যজুর্বেদে অন্ত্যেষ্টি ক্রিয়া (দাহক্রিয়া) ও মন্ত্রোচ্চারণের নিয়ম বর্ণিত। সামবেদে মৃত আত্মার শান্তি ও দেবলোকে গমনের প্রার্থনা আছে।

বেদে দাহ প্রথার মূল দর্শন

  • অগ্নি দেহ ভস্ম করে আত্মাকে মুক্ত করে।
  • দেহ পঞ্চভূতের সমষ্টি — দাহে প্রকৃতিতে পুনর্মিলন ঘটে।
  • আগুন অপবিত্রতা দূর করে ও পরিবেশ শুদ্ধ রাখে।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে

ঋগ্বেদের প্রাচীন যুগে কিছু অঞ্চলে দাফন প্রথাও প্রচলিত ছিল। কালের পরিক্রমায় দাহ প্রথাই সর্বজনীন ও প্রতীকী রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।

উপসংহার

সনাতন ধর্মে দাহ প্রথা কুসংস্কার নয়, বরং গভীর দর্শন, বিজ্ঞান ও প্রকৃতির নিয়মের উপর প্রতিষ্ঠিত এক পবিত্র রীতি। দেহ প্রকৃতির উপাদান থেকে সৃষ্টি, আর দাহের মাধ্যমে সেই প্রকৃতিতেই ফিরে যায়। অগ্নি আত্মাকে মুক্তি দেয়, আর আত্মা তার অনন্ত যাত্রায় এগিয়ে যায়।

“দেহ নশ্বর, আত্মা অমর।” — ভগবদ্‌গীতা ২.২০

সংক্ষেপে

কারণ সারসংক্ষেপ
দর্শন দেহ পঞ্চভূত থেকে গঠিত, দাহে পুনর্মিলন ঘটে
আধ্যাত্মিকতা অগ্নির মাধ্যমে আত্মার মুক্তি
স্বাস্থ্য জীবাণু ও রোগ প্রতিরোধ
প্রতীক নশ্বরতা ও পবিত্রতার প্রতীক
বেদীয় উৎস ঋগ্বেদ, অথর্ববেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ

FAQ — সাধারণ প্রশ্নোত্তর

সনাতন ধর্মে মৃতদেহ দাহ কেন করা হয়?

দেহ পঞ্চভূত থেকে গঠিত, দাহে সেই উপাদানগুলিতে বিলীন হয়ে প্রকৃতিতে ফিরে যায়।

দাহ কি আত্মাকে মুক্তি দেয়?

হ্যাঁ, অগ্নি আত্মাকে শরীর থেকে মুক্ত করে এবং মোক্ষ বা পুনর্জন্মের পথে পাঠায়।

বেদে কি দাহের উল্লেখ আছে?

ঋগ্বেদ (মণ্ডল ১০, সূক্ত ১৬), অথর্ববেদ, যজুর্বেদ ও সামবেদে স্পষ্টভাবে দাহ প্রথা বর্ণিত হয়েছে।

সব হিন্দুই কি দাহ করে?

না। শিশু, সন্ন্যাসী এবং বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে সমাধি বা বিসর্জনের রীতি পালন করা হয়।

Reference:
  • ঋগ্বেদ ১০.১৬ — অন্ত্যেষ্টি সূক্ত
  • অথর্ববেদ ১৮.২.২৮
  • যজুর্বেদ ৩৯.৬
  • সামবেদ ৩২.১
  • ভগবদ্‌গীতা ২.২০

শ্রদ্ধা জানাই জ্ঞানকে, সম্মান রাখি সৃষ্টিতে। Vedayaan (বেদায়ান)-এ প্রকাশিত প্রতিটি লেখা, ছবি ও উপস্থাপন অনন্য এবং সযত্নে প্রস্তুত। এই পোস্ট বা এর যেকোনো অংশ অনুমতি ছাড়া কপি, পুনঃপ্রকাশ বা সম্পাদনা করা আইনত নিষিদ্ধ। কোনো ধরনের অননুমোদিত ব্যবহার করলে কঠোর আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমাদের প্রয়াসের মর্যাদা রাখতে অনুগ্রহ করে কোডে মূল ক্রেডিট বজায় রাখুন।

Copyright

Vedayaan (বেদায়ান)
l

কথোপকথনে যোগ দিন